“তোমার মেরুদণ্ডহীন সিস্টেমের কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানলাম। বোকার মতো শিরদাঁড়াটা সোজা রেখে জীবনটা পার করার যে জেদ ছিল সেটা তোমার মেরুদণ্ডহীনতার তন্ত্রে হার মেনে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিতি থেকে এবং সিজিপিএ’র জন্য পড়াশোনা করে মেধাবী তকমা পাওয়া কিংবা দুর্ঘটনায় বা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর পর মিডিয়ার প্রচারের স্বার্থে মেধাবী খেতাব নেওয়ার কোন ইচ্ছা ছিল না। শুধু শুধু গাধার মতো কোন ইস্যু পেলে চেঁচিয়ে বারবার তোমার মেরুদণ্ডহীনতা বোঝানো ছাড়া বোধ হয় আমি আর কিছু পারতাম না।”
অর্ঘ্য বিশ্বাস এসব লিখে রেখে ক্ষয়শীল এই ধরণীকে চিরবিদায় জানায়। মুঠোয় অর্ঘ্য বিশ্বাসের জীবনের শেষ কতগুলো শব্দ কাগজের মাঝে চেপে প্রায় আধঘণ্টা যাবত সরলরেখায় নিজের ঘরে পায়চারী করছে ইফতেখার। কখনও দেখতে পাই মাথা চুলকাচ্ছে, কখনও রুমের মাঝখানে অকারণ দাঁড়িয়ে আছে, কখনওবা নিজের কর্মতাল নিজেই ধরতে পারছে না বলে বোধগম্য হয়। আজ বিশ্ববিদ্যালয় অঘোষিত ছুটি। কারণ বিরোধীদলের ডাকা হরতাল। বিরোধীদল হলে হরতাল ডাকবে আর ক্ষমতায় গিয়ে বসলে হরতালের নিন্দা করা হবে, অতি সাধারণ বহুদূরব্যাপী দৃশ্যমান বিষয় আমাদের। হরতালে ক্লাস বাতিল এবং তা পূরণের স্বার্থে পরবর্তীতে নির্ধারিত সময়ের মাঝে বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগের কথা ভেবে বিরক্তিবোধ গেঁথে বসতে থাকে ইফতেখারের শরীরে।
আজ মঙ্গলবার। গত রবিবার হরতাল গেল, আজ আবারও হরতাল। হরতাল মানে ক্লাস বাতিলের অঘোষিত ঘোষণা গায়ে বাতাস লাগিয়ে দায়মুক্ত হয়। কিন্তু ইফতেখারের আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া দরকার। গত বৃহস্পতিবার লাইব্রেরীতে অসমাপ্ত ভাবে পড়ে আসা একটি বই তাকে প্রবলভাবে টানছে। পায়চারীর সাথে সে ভাবছে যাবে কি যাবে না। মাথার মধ্যে যা ভর করে থাকে তা কোন কোন সময় নামিয়ে ফেলা উপাদেয় হয়। বাসায় ইন্টারনেটের সংযোগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটাও পাওয়া যাবে। তো বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হবে।
শার্ট প্যান্ট পাল্টে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেড়িয়ে যায় সে। রাস্তায় নেমে প্রথমে তার ইচ্ছে ছিল রিক্সা নিয়ে যাবে। হরতাল প্রদত্ত একমাত্র আনন্দ – রিক্সা নিয়ে যাতায়াত করা যায় যেকোন রাস্তায়। ইফতেখার সে ইচ্ছে ছুড়ে ফেলে হেটে রওনা দেয় ধানমন্ডির উদ্দেশ্যে, বিশ্ববিদ্যালয় ধানমন্ডিতে। ঢাকার রাস্তা ফাঁকা পাওয়া যায় না এই হরতাল ছাড়া যে নিজেকে মুক্ত বিহঙ্গ ভেবে নিয়ে হেঁটে যাওয়া যাবে অনেকটাপথ। হরতালে হাটা যায়। হাটাহাটি করলে চিন্তা করতে সুবিধা হয়। মাথা চিন্তার কাজ চালিয়ে যায় অবিশ্রাম। ইফতেখারের মাথায় ঘুরপাক খায় “নির্বাণ”। যে শব্দটিকে বৌদ্ধ ধর্মে বলা হয় সাধনার চরম প্রাপ্তি। অব্যক্ত, অনির্বচনীয়, তৃষ্ণার বিনাশই নির্বাণ। যেখানে জন্ম নেই, জরা নেই, ব্যাধি নেই, মৃত্যু নেই, শোক নেই। যেখানে সংসার স্রোতের গতি রুদ্ধ হয়েছে, সেই পরম অবস্থা। জটিল সব ব্যাপার স্যাপার। ইফতেখারের পছন্দ সাধারণ সবকিছু। সাধারণ হিসাব, সাধারণ জীবনধারণ। কম চাহিদা পূর্ণ শান্তিব্যাবস্থা। এইতো জীবন।
বিবিএ তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ইফতেখার। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ মেলেনি। বাবা মা’র সাথে মোটামোটি জোরাজুরি করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হয়ে ভর্তি হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভর্তির এক-দেড় বছর পর ইফতেখার বুঝে যায় এই জায়গা তার জন্য নয়। ঠিক পোষাচ্ছে না। খোরাক থাকে অপূর্ণ; মনের সাথে মিল না হলে যা হয়ে যায় স্বাভাবিক। ঘটে যাওয়া ঘটনা পাল্টানো যায় সেই সাধ্য আছে কার! ইফতেখার সাত মসজিদ রোড দিয়ে এগিয়ে যায় ধানমন্ডির দিকে।
হাটতে হাটতে সে চলে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ষাট-সত্তুর ফুট দূরত্বে একটি মোটামোটি আকারের জটলা দেখতে পায়। তাদের উচ্চারণে কোন শ্লোগান নেই বলে বোঝা যায় না তারা হরতাল সমর্থক না হরতাল বিরোধী। আর মাথা না ঘামিয়ে ইফতেখার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটক পর্যন্ত চলে যায়। ফটকে ভাল মানের দুইটি তালা ঝুলছে দেখতে পায়। আশেপাশে কোন দারোয়ানেরও দেখা মেলে না। ইফতেখার ঠোঁটে বিরক্তিসূচক শব্দ তুলে ঘুরে দাঁড়ায় – কাজ হল না; তবে আজ বাকি অংশ পড়ে ফেলতে পারলে বেশ হত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে জটলাটি আগের জায়গাতে দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরের গুঞ্জন বাড়ছে তার উত্তাপ টের পাওয়া যায়। দুইজন চারজন টুকরো টুকরো করে এসে জটলাটির সাথে মিশে যাচ্ছে। আসে পাশের ক্রমবর্ধমান উৎসুক জনতার কমতি নেই। সবার মনে যে একই আশংকা বিরাজমান তা একই ধরণের মুখভঙ্গি দেখে আঁচ করা যায়। রাস্তায় দুই চারটি সিএনজি চলছে। বেশ কিছু রিক্সা আছে সবসময়ের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে। দুই একটি গাড়ী আসছে যাচ্ছে। গাড়ীর চালকেরা জটলাটির কাছে এসেই সাঁই টেনে বের হয়ে যাচ্ছে।
ইফতেখার মাথা ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে এসব লক্ষ্য করে যাচ্ছে। জটলাটির পেছন দিকটায় বেশ কিছু টং দোকান। ইফতেখার সেখানের একটি দোকানে নিয়মিত চা টা খায়। টা খাওয়া শুরু করেছে বছর তিনেক। ধোঁয়ায় আলাদা কোন স্বাদ নেই সাধ ছাড়া। । ইফতেখার নির্দিষ্ট দোকানটার দিকে এগিয়ে গেল। “মামা, একটা চা দেন, আর একটা বেনসন দেন লালটা।” দোকানদার চা আর সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বলল “মামা আইজ আপনাগো ক্লাছ নাই?”
ইফতেখারের চোখ তখন সামনের রাস্তায়। দোকানদারকে উত্তর দেয়ার আগেই রাস্তার উল্টা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ত্রিশ-চল্লিশজনের জটলাটি রাস্তার পুরোটা দখল করে দাঁড়িয়েছে। তারা একসাথে “হরতাল হরতাল” বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে শুরু করলো। এর মাঝে পাঁচ ছয় জনের কয়েকটি ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে তাদের হাতের বাঁশ দিয়ে দুই তিনটি রিক্সা পিটিয়ে ভাঙতে চেষ্টা করলো। একটি দল একটি রিক্সা টেনে রাস্তায় ফেলে দিল। একজন জানিনা কোথা থেকে একটি বড় টায়ার এনে রাস্তার মধ্যে জ্বালিয়ে দিল পেট্রোল ঢেলে। ধাঊধাঊ করে আগুন জ্বলে উঠল সাথে উড়ে গেল ভাড়ী কালো ধোঁয়া। বিশ পঁচিশ হাত দূরে অন্য একজন আরও একটি টায়ার জ্বেলে দিল। আসে পাশের মানুষ দৌড়াঝাঁপ দিয়ে যে যার মত করে সরে যেতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। আচমকা কারবার গুটিয়ে দোকানপাটের ঝাপ পরতে থাকে। অনেক মানুষ নিরাপদ দূরত্বে থেকে সব দেখায় মগ্ন হয়ে থাকে। একটি টয়োটা গাড়ী এসে আটকা পড়ে গেল হরতালের প্রকৃত রূপে। সাত আটজন চরম উৎসাহে লেগে গেল গাড়ী ভাংচুরে। প্রথমে ইট ছুড়ে মারলো, পরে লাঠি বাঁশ দিয়ে গাড়ীর গ্লাস ভাঙতে লাগলো। গাড়ীর চালককে একজন টেনে বের করে দিল। চালক বেচারা মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো অদূরে। আর কিছুই করার নেই। কিছু সময় দেখে যেতে হবে অবধারিত ধ্বংস।
সবাই যখন লীলা উপভোগে ব্যাস্ত ইফতেখারের চোখ তখন আটকে যায় হাফ প্যান্ট গায়ে ছেড়া গেঞ্জি জড়ানো একটি বার-তের বছর বয়সের ছেলের দিকে। যে হরতাল সমর্থনকারীদের সাথে সমান তালে তাল মিলিয়ে ‘হরতাল হরতাল’ ধ্বনি তুলে শ্লোগান হাঁকছে আর রাস্তা থেকে কুড়িয়ে ইটের টুকরো তুলে গাড়ীতে ছুড়ে মারছে। সুযোগ পেলে মাঝে মাঝে দৌড়ে গিয়ে গাড়ীতে উড়ন্ত লাথি ঝারছে।
কিছুক্ষণ এমন চলতে থাকার পর সাইরেন বাজিয়ে দুইটি পুলিশের গাড়ী এসে দাঁড়ায়। যদি কাউকে ধরতেই আসে তবে সাইরেন বাজিয়ে কেন আসে ইফতেখারের বোধগম্য হয় না। পুলিশের গাড়ী থামার সাথে সাথে পিকেটারদের যে যেদিক দিয়ে পারে পালাতে শুরু করে। পুলিশও তাদের পিছনে পিছনে এক হাতে লাঠি উঁচিয়ে দৌড়ে যায় অনেকদূর। ইফতেখারের বাংলা সিনেমার কথা মনে পড়ে যায় – একটি ফাঁকা গুলি এবং সাথে একটি সংলাপ “আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না।”
ইফতেখার আবার বাচ্চা ছেলেটির দিকে চোখ ফেরালো। হরতাল সমর্থনকারীরা যখন দৌড়ে পালাতে ব্যাস্ত সে সবার সাথে দৌড়ে গেল না। শান্ত হয়ে ভীড় ছেড়ে হেটে গেল শুধু। ছেলেটির এই ক্লান্তিহীন শান্ত হাটুনি ইফতেখারকে আকৃষ্ট করলো। ঘটনা কি! ইফতেখার উঠে দাঁড়িয়ে ছেলেটিকে লক্ষ করতে থাকলো। ছেলেটি ধীরে হেটে রাস্তার পাশে গেল। সেখান থেকে সে একটি চটের বস্তা উঠিয়ে কাঁধে নিল। কাঁধে নিয়ে পাশে পড়ে থাকা দুইটি খালি পানির বোতল তার চটের বস্তায় ঢুকিয়ে আসে পাশে আরও কিছু পাওয়া যায় কিনা খুঁজে দেখলো। কিছু না পেয়ে রাস্তা পাড় হয়ে এলো। একবারও সেই গাড়ীটির দিকে ফিরে তাকালো না আর। কোন মানুষের মুখেও তাকালো না। পুলিশের পাশ দিয়ে রাস্তায় কিছু খুঁজতে খুঁজতে ইফতেখারের পাশ দিয়ে ভিতরের রাস্তায় ঢুকে গেল। মূলত ইফতেখার বেশ মজা পেল। ইফতেখার চায়ের কাপ আর দাম মিটিয়ে ছেলেটির পিছনে পিছনে হাটা শুরু করল।
ইফতেখার ছেলেটিকে অনুসরণ করে এগিয়ে যাচ্ছে আর ওর কান্ডকারখানা উপভোগ করছে। ছেলেটি রাস্তা থেকে যা যা পারে উঠিয়ে তার বস্তায় নিয়ে নিচ্ছে। কোন বাড়ী থেকে একটি গামছা এসে রাস্তায় পরেছে সেটাও বস্তায় নিয়ে নিল চট করে। রাস্তার নিরিবিলি জায়গায় কোন গাড়ী পেলে আসে পাশে কেউ আছে কিনা দেখে নিয়ে গাড়ীর দরজা টেনে দেখছে। কোন গাড়ীতে যখন এলার্ম বেজে উঠছে গাড়ীর টায়ারে একটা লাথি মেরে দৌড়ে পালাচ্ছে। রাস্তার অলি গলির ভিতরে অর্ডারে জুতা বানায় এমন এক দোকানের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সচেতনে এক পায়ে একটি স্যান্ডেল দিয়ে হেটে কিছুদূর চলে গেল তারপর সেটা বস্তায় ঢুকিয়ে ফেলল। ইফতেখার দেখছে আর অবাক হচ্ছে। ছেলেটির কোন কিছুতে কোন ক্লান্তি নেই। একটির পর একটি কান্ড করে যাচ্ছে। পথচলাতেও কোন বিরতি নেই। প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা হাটার পর বস্তির একটি অতি সরু চিপা দিয়ে হঠাৎ হারিয়ে গেল। এত সরু গলি যে ইফতেখারের সেখানে প্রবেশ করা অসাধ্য। যে কারণে ইফতেখার এতক্ষন ছেলেটিকে অনুসরণ করে এলো সেটি আর জানা হল না। ইফতেখার কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে যখন আর কোন সম্ভাবনা উপলব্ধি করতে পারলো না তখন সে বাড়ীর পথে ফিরে গেল।
তিনদিন পরের ঘটনা। ইফতেখার বাড়ি থেকে বের হয়েছে মাথায় কিছু এলোমেলো চিন্তা ভাবনা নিয়ে। অর্ঘ্য বিশ্বাসের আত্নদ্রোহের ব্যাপারটি মাথা থেকে সরছে না। তার লেখা ছোট ছোট পত্রসমূহ নিয়ত নিয়মমাফিক মাথায় হানা দিয়ে যাচ্ছে। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে একটি রিক্সায় উঠে নিজের ভাবনার মধ্যে বুঁদ হয়ে রইলো।
উথাল পাথাল ভাবতে ভাবতে ইফতেখার রিক্সা থেকে নেমে একটি আইসক্রিম কিনে বসে খাচ্ছে। মোদ্দাকথা নির্বাণ লাভ করা সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব না। লোভ লালসা কামনা বাসনা আকাঙ্ক্ষা ইচ্ছা স্বপ্ন আশা ভরসা প্রেম ভালবাসা চাহিদা এগুলো ছাড়া মানুষ কই!
ক্লাস শুরু হতে এখনও কিছু সময় বাকি। অল্প সময়ের মধ্যে ইফতেখার সেই দিনের টোকাই ছেলেটিকে দেখতে পেল। সামনে দিয়েই হেঁটে গেল। পড়নে সেই একই প্যান্ট আর ছেড়া গেঞ্জি। তাকিয়ে রইলো ইফতেখার। ছেলেটি অল্প একটু দূরে ফেলে রাখা ময়লা থেকে নিজের প্রয়োজনীয় দ্রব্যটি খুঁজছে।
ইফতেখার “এই ছেলে শোন” বলে ইশারায় কাছে ডাকলো। ছেলেটি এগিয়ে এসে একবার আইসক্রিমের দিকে একবার ইফতেখারের মুখের দিকে তাকায়। ইফতেখার কিছু না বলে আইসক্রিম খেয়ে যায়। ছেলেটি কিছুক্ষণ আইসক্রিম খাওয়া দেখে একসময় জিজ্ঞেস করে, “কিছু কইবেন?”
তোমার নাম কি?
ইফতেখার বুঝলো এই ছেলেকে আপাতত বোঝানো সম্ভব না। বক্র ছেলে বোধ হয় একেই বলে। ইফতেখার আইসক্রিম কিনে এনে আজাদের হাতে দিল। ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছে। এখন যাওয়া দরকার। ইফতেখার আজাদকে কাছে টেনে এনে বলল, “আজাদ আসলেই ভাংচুর ঠিক না। এগুলো আর কোরো না কেমন? আর শোন মাঝে মাঝে এখানে এলে আমাকে পাবে। ঐ যে উঁচু বিল্ডিংটা ওইটাতে আমি পড়ি। এসে আমার সাথে দেখা করবে। তোমাকে আইসক্রিম খাওয়াবো। কিন্তু শর্ত একটাই তোমাকে যা যা করতে মানা করলাম তা করবে না।”
আজাদের মনোযোগ এখন শুধু আইসক্রিমের দিকে। সে খুব যত্ন সহকারে আইসক্রিমের আবরণ ছিড়ছে। “খালি হরতালের দিন ভাংমু, হরতালের দিন ভাঙলে কেউ আমারে ধরতে পারবো না” বলে সব গুলো দাঁত বের করে একটি হাসি দিয়ে “আইজকা যাই” বলে উল্টো পথে হেঁটে যায়।
ইফতেখারও হাসি মুখে বিশ্ববিদ্যালয় নামক বিন্ডিংয়ে যাওয়ার জন্য হাঁটা শুরু করেও বাড়ির পথে পা বাড়ায়। চলতি পথে ব্যাগ থেকে অর্ঘ্য বিশ্বাসের একটি লেখা সমেত একটি কাগজ বের করে পড়তে থাকে।
“তোমার মেরুদণ্ডহীন বিদ্বান সূর্য সন্তানেরা তোমার এত উন্নতি করছে সেখানে আমি তোমার কি উপকার করছি বল? তোমার টাকায় পড়ে, খেয়ে তোমার সিস্টেমের বিরোধিতা করছি, তোমার সাথে বেঈমানী করছি। দেখে নিও, আর করব না। সেদিন ভিসি স্যার এবং চেয়ারম্যান স্যারের কাছে মাফ চাইনি। আজ তোমার কাছে মাফ চাইছি। তোমার আর কোন ক্ষতি করব না। আর তোমার বিরোধিতা করব না। সোজা হওয়া এই মেরুদণ্ড ভেঙ্গে নোয়াতে পারব না। সেটা আমার দ্বারা হবে না। সেজন্য অন্য পথটা বেছে নিলাম। ভয় পেয় না। ধর্মান্ধতায় অন্ধ, ক্ষমতাবলে ভীত, অর্থ মোহে ঘুমন্ত এই বালির নিচে মাথা ঢুকিয়ে থাকা উটপাখি সদৃশ জাতি কোনদিনও তোমার ভেঙ্গে পড়ে থাকা মেরুদণ্ড সোজা করার চেষ্টা করে তোমাকে যন্ত্রণা দিবে না। আমার মতো যেসব বেয়াদবেরা তোমার সিস্টেম বাগের কারনে ভুল করে জন্মেছে তারাও আস্তে আস্তে তোমার সিস্টেমের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে। আশাকরি পৃথিবীতে তুমি তোমার উন্নতির ধারা বজায় রাখবে। ভাল থেকো।”
পড়া শেষে ইফতেখারের মাথায় কিছু কথা খেলে যায় – অর্ঘ্য বিশ্বাস কিংবা আজাদ দুইজনই একনায়ক আন্দোলনের দুইটি মুখ। আন্দোলন; যে আন্দোলন কোন দিন তারিখ স্থান কাল মানে না। যে আন্দোলনের কোন সময় নেই, যেকোন ক্ষণে শুরু হয়ে যায় শুধু; ভিন্ন ভিন্ন পথে।
© Shihab Shahariare Khan ||