আমি মুক্তিযোদ্ধা।
১১নং সেক্টর কমান্ডার।
এবং বীরউত্তম।
আমি অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল।
আমিই অবসরপ্রাপ্ত লেঃ কর্ণেল আবু তাহের।

পেইন্টার ভ্যানগগ প্রেমিকার জন্য কান কেটে ফেলেছিল
আমি আমার দেশের জন্য পা কেটে ফেললাম।

১৬ই ডিসেম্বর
মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাভাবিক বিজয়ের ফলশ্রুতি নয়
বরং তা দেউলিয়া রাজনীতির অধৈর্য্যের ফল।
ক্ষমতা তাদের হাতে স্থান পেল না
জয়ী হয়ে তারা হেরে গেল,
ষড়যন্ত্র পঙ্গু করে গেল মুক্তিযোদ্ধাদের,
মুক্তিযোদ্ধা-রাজাকারের প্রভেদ ঘুচে গেল।
পাকিস্তানী সৈন্যর সাথে কাধ মেলানো সামরিক অফিসার
পদন্নোতি পেল দফতরে।
মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দেয়া পুলিশ অফিসার
ব্যস্ত হল মুক্তিযোদ্ধাদের হুলিয়া বের করতে।
রাজাকার বাহিনী তৈরির আমলারা পেল
মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরি দান ও দয়া প্রদর্শনের অধিকার।
দেশের ডাকে সাড়া দিতে না পারা শিক্ষক
পেল তরুণদের দায়ভার।
মুক্তিযুদ্ধের পর প্রতি দেশে কন্সেন্ট্রেসন ক্যাম্প করা হয়
আমাদের তা হয়নি,
কায়িক শ্রমের মাধ্যমে যুদ্ধবিরোধীদের আত্নশুদ্ধির সুযোগ দেয়া হয়
যাতে তারা বিপ্লবী জনতার অংশ হতে পারে
আমাদের তা হয়নি,
কন্সেন্ট্রেসন ক্যাম্পে যারা নেবে আত্নশুদ্ধির লেসন
তারা নিল দখল নেতৃত্বের আসন।

এক এক করে ডিআইজি’র রুমে হাজির করা হল
মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত মেজর এম এ জলিল
সুন্দরবন কাঁপানো বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জিয়াউদ্দীন
সহযোদ্ধা হাসানুল হক ইনু
সহযোদ্ধা আ স ম আবদুর রব
সহযোদ্ধা ডঃ আখলাক
সহযোদ্ধা মোঃ শাহজাহান
মাহমুদুর রহমান মান্না
হাবিলদার হাই
আমার ভাই আবু ইউসুফ বীরবিক্রম
আমার ভাই মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন
আমার ভাই মুক্তিযোদ্ধা বেলাল সহ আমাদের বত্রিশজনকে।
অযৌক্তিক ভাবে বানানো আদালত,
আমার হাতে মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে দাঁড়ানো সরকার
আজ আমার বিচার শোনাবে।
আমাদের বিচার করবে।

পাকিস্তানী তাবেদার নিল আমার বিচারভার।
ট্রাইব্যুনালের রায় দেয়া হল;
আমার জন্য নির্ধারিত হল মৃত্যুদন্ড।

আমাকে কি কেউ হত্যা করতে পারে?
আমাকে কেউ হত্যা করতে পারবে না
আমি আমার সমগ্র জাতির মধ্যে প্রকাশিত
আমাকে হত্যা করতে হলে
পুরো জাতিকে হত্যা করতে হবে।

আমি এই দেশে মীরজাফরকে দেখেছি,
দেখেছি নতুন করে জন্ম নিতে;
পোশাক পাল্টে রাষ্ট্রপ্রধানের সিংহাসনে গেড়ে বসতে।
তবে আমি জানি, মীরজাফররা যেভাবে আসে
সেভাবে বিদায় নিতে বাধ্যও হয়।


আমার বসানো রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা
চাইতে বলা হল আমাকে, আমি কেন ক্ষমা চাইবো?
কে ও? ওর কি যোগ্যতা আছে আমাকে ক্ষমা করার?
কিসের জন্য ক্ষমা?
কবি নজরুল ইসলামকে বলতে ইচ্ছা করে,
আমিও ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গেয়ে গেলাম।
আমি জেনেছি জননীর পদতলে জীবন বিলাতে
শিখিনি নিজের জন্য অনৈতিক ক্ষমা ভিক্ষা চাইতে।

আমাদের বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ বীরের জাতি।
এক অদম্য প্রেরণায় উদ্ভাসিত।
আমি ভীত নই; আমি গর্বিত।
আমি আমার দেশ ও জাতিকে ভালবাসি।
নিশঙ্ক চিত্ত জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ
আমার জাতিকে তা অর্জনের ডাক দিয়ে যাই।
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।
চিরজীবী হোক স্বদেশ।

তোমার ভয় নাই পৃথিবী
ক্ষুদিরাম মরেছে যেভাবে; আমিও মরব সেভাবে।

জন্মেছি, সারা দেশটাকে কাপিয়ে তুলতে
কাপিয়ে দিলাম।
জন্মেছি, তোদের শোষণের হাত দুটো ভাঙ্গব বলে
ভেঙ্গে দিলাম।
জন্মেছি মৃত্যুকে পরাজিত করব বলে
করেই গেলাম।
জন্ম আর মৃত্যুর দুটো বিশাল পাথর
রেখে গেলাম।
পাথরের নিচে শোষক আর শাসকের
কবর দিলাম।
পৃথিবী – অবশেষে এবারের মত বিদায় নিলাম।

আমি এমন একটা বাংলাদেশ কল্পনা করি
যার ভিত্তি নদী, নদীর দুপাশে উঁচু বাঁধ
তার উপর দিয়ে চলে গেছে সোজা পাকা রাস্তা
রেল লাইন, ইলেক্ট্রিসিটি, গ্যাস, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ লাইন।
বাঁধের দুই পাশে ছড়ানো গ্রাম
নির্দিষ্ট দুরুত্বে অনেক বাড়ী
বাড়ীর পেছনে রকমারি সবজির সমারোহ।
এক একটা জনপদ।
সামনে সবুজ ঘাসে ঢাকা বাগান, সেখানে ফুল
খোলা মাঠ
বুড়োরা মাঠের চারপাশে বসে গল্প করে
ছেলে মেয়েরা মেতে ওঠে খেলায়।
সকাল বেলা সামনের সোজা সড়ক
বাসের হর্ন শোনা যাবে।
হৈ চৈ করে ছেলে মেয়েরা স্কুলে যায়
বিভীষিকা নেমে আসে না সন্ধ্যায়
রাস্তায় জ্বলে ওঠে বিজলী বাতি।
বৃদ্ধরা গ্রামের মিলনকেন্দ্রে যায়
সারাদিনের কাজ পর্যালোচনা করে
আগামীর পরিকল্পনা করে
সেখানে বসে তারা টেলিভিশন দেখে
জনপদের অগ্রগতির নানা খবর পায়,
পায় নেতার নির্দেশ।
বর্ষায় স্লুইচ গেট দিয়ে বন্যার পানি আসে
ফসলের ক্ষেতগুলোকে প্লাবিত করে
আবৃত করে পলিমাটিতে।
জনপদের বাঁধের উপরই গড়ে উঠেছে
কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, চিত্রশালা, নাট্যশালা,
হাসপাতাল, শিল্প কারখানা, বিমানবন্দর।
নদীর পাশে গড়ে ওঠা জনপদের
মানুষেরা সুস্থ, হাসে, গান গায়।
এমন সোনার বাংলা গড়তে আমি জন্মেছিলাম।

আমাদের অশিক্ষিত করে রাখার চেষ্টা কিন্তু হয়
চেষ্টা হয় চোখে টিনের চশমা পড়িয়ে দেয়ার।
দেশবাসী তোমরা ইতিহাস জেনো
নয়ত তোমরা নিজেকেই জানবে না।
নিজের গোড়াপত্তন জানতে হয়,
সবসময় নাড়ীর সাথে যোগাযোগটা রাখতে হয়
নয়ত ইতিহাস কি তোমাকে ক্ষমা করবে? ভেবে দেখো।

২১ জুলাই ১৯৭৬ আমার মৃত্যুদন্ড কার্যকর হবে।
আমার জন্য বরাদ্দ নিঃশ্বাস শেষ হয়ে আসছে।
আমি আমার জীবনের বিনিময়ে
এই দেশের মানুষের জীবনের শান্তি কামনা করি।

 

কর্ণেল তাহেরের গান

© Shihab Shahariare Khan ||