কাটাখালীর মোড়ে বাস পুরোপুরি থামলে কাঁধে ঝোলা নিয়ে ধীর পায়ে নেমে আসে জহিরুল। বাগেরহাট থেকে বাস যোগে এতটুকুই তার গন্তব্য। বাসটিকে খুলনার উদ্দেশ্য চলে যেতে দ্যাখে সে। সে দৃশ্য দৃষ্টি সীমায় বিলীন হয়ে গেলে সংজ্ঞা ফিরে আসে তার, দ্রুত হেঁটে নেমে যায় মোংলা বাজারের দিকে। একটি চাকরী খুব দরকার। ক্লান্তি আর বয়ে বেড়ানো যাচ্ছে না।
গত পরশু রাতের বাসে চেপে ঢাকায় গিয়ে একটি চাকরীর সাক্ষাৎকার দিয়ে আবার বাসে চেপে ফিরে আসতে হলো। রাত্রিযাপণের জন্যে যেমন ছিল না কোন আত্নীয়ের বাড়ি তেমনি হোটেলে থাকার মতন টাকাকড়ি। টানা দুই রাতের যাতায়াতের ধকল শরীর আর সহ্য করছে না। ঘাটে নেমে জানতে পারে অল্প কিছুক্ষণ হল একটি ট্রলার ছেড়ে গেছে। পরের যাত্রা আরও মিনিট ত্রিশ পরে।
নদীর ধারের একটি চায়ের দোকানে পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে আবার চাকরীর ব্যাপক প্রয়োজনীয়তার অনুভূতি জেগে ওঠে অন্তরে। স্বয়ং তার মাথা অসম্মতি জানানোর ভঙ্গিতে দুলতে থাকে, নাহ চাকরীটা না জুটলে শেষমেষ বাপের মাছ ধরার পেশা বরন করতে হবে। অন্যের আশ্রয়ে আর থাকা ঠিক হবে না।
হঠাৎ পন্য বোঝাই একটি জালিবোট যাত্রার উদ্দেশ্যে তৈরি হচ্ছে দেখে চায়ের দাম মিটিয়ে উঠে পরে জহিরুল। দ্রুত জালিবোটের কাছে গিয়ে মাঝিকে জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাবেন?
মাঝি উল্টো প্রশ্ন করে, আপনে যাবেন কুবায়?
জহিরুল বলে, চিলা বাজার।
মাঝি হাতের ইশারায় ডাকে, চলেন আমরাও চিলে বাজারেই যাইতিছি।
নদীর এপারে মোংলা বাজার ওপারেও মোংলা বাজার এবং বড় রাস্তা। ঘন্টাখেনেকের পানিপথ মোংলা বাজার থেকে চিলা বাজার। জালিবোট পশুর নদীর ঢেউ মাড়িয়ে কেঁপে কেঁপে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। বাতাসের দমক বেড়ে যায় নিমেষে। আকাশের অবস্থাও কালো হয়ে যেতে দেখা যায়। ঝড় ঘনিয়ে আসছে হয়ত। পানির ঝাপ্টা এসে শরীর ভেজানোর খেলায় মেতে উঠছে ধীরে কিন্তু উন্মাদের মতন। এর মধ্যে সময় চলে গিয়েছে অনেক। জহিরুল গাঁ বাঁচিয়ে বসার চেষ্টা করতে করতে সম্মুখে গ্রামটির দিকে মুখ তুলে তাকায়। বানীশান্তা গ্রাম। এক মধ্য বয়স্কা নারীকে নির্দ্বিধায় কোমর পানিতে অর্ধউলঙ্গ হয়ে গোসল করতে দেখা যাচ্ছে। সে হয়ত কাউকেই আর তোয়াক্কা করে না। এই গ্রামের আরও অনেক নারী আছে যারা কাউকেই তোয়াক্কা করে না।
জহিরুল দূরের সবুজের দিকে তাকায়। সুন্দরবন তার কাছে মোটেও আর আপণ জায়গা নয় বরং অপছন্দ। দুই বছর আগে আম্মাকে বাঘ টেনে নিয়ে যায় পাচদুয়ার থেকে, পরের বছর সিডর ঘরবাড়িসহ বাপকে মেরে রেখে যায়। অতীতকাল বাল্যকাল সুখ অসুখ ভাবতে ভাবতে জালিবোট এসে নোঙর ফেলে চিলা বাজারের ঘাটে। আপাতত কিছুদিনের আশ্রয় এই অঞ্চল।
চিলা বাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাংলার খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত জহিরুল কোনমতে খেয়ে অস্থায়ীভাবে আশ্রিত হয়ে বসবাস করছে খোকন জাইল্লার বাড়িতে। বৃষ্টি হলেই চালের ফুটো দিয়ে পানি পরতে থাকে সে বাড়িতে। তবে খোকনের বউ আতিয়া’র হাতের রান্না উপাদেয়। অতি কর্মঠ নারী, স্বামী খোকনের থেকে মাছ ধরায় তার দক্ষতা বেশি। তবে ছাওয়াল রাইখা তার মাছ ধরতে যাওয়ার উপায় নেই। মা চোখের আড়াল হলেই ছাওয়াল ট্যাঁ ট্যাঁ শুরু করে, ঠিক ততক্ষণ যতক্ষণ ফিরতি মায়ের দেখা না পায়।
জহিরুল বড় রাস্তা থেকে নেমে আইল ধরে হেঁটে বাড়ির পথ ধরে। আইলের দুই ধারে প্রশস্ত বন্ধ্যা বিল। লবণ পানির অঞ্চল বিধায় ধান হয় না, ফসল ফলে না। জহিরুল বড় রাস্তার দিকে কি মনে করে ঘুরে তাকায় একবার। হয়ত আশা করেছিল পরিচিত কেউ সেখানে আছে। কিন্তু কেউ নেই। এই বড় রাস্তা সোজা চলে গেছে কয়েক মাইল দূরে জয়মুনি পর্যন্ত। জয়মুনি এই অঞ্চলের শেষ মাথা। সেখান থেকে পশুর নদী বাঁক নিয়ে ঘুরে গেছে অন্যদিকে। তার ওপারেও বিস্তীর্ন সুন্দরবন। ওদিকটায় যায় না জহিরুল; অপছন্দের কাছে যেতে নেই। সে অপছন্দ দেখতেও চায়না।
গিরীশ, খলিল, পুতুল, রাতুল, শশী সহ নয় দশ জনের দুইটি বালক বালিকার দল পুকুরের পাড়ে আরও দুইটি পুকুর খননের কাজে ব্যস্ত। দৈর্ঘ্য মোটামোটি এক থেকে দেড় ফুট, প্রস্থও প্রায় এক থেকে দেড় ফুট আর গভীরতা এক ফুটের মতন। খনন কাজ শেষ হয়ে গেলে তাতে পানি দিয়ে পরিপূর্ণ করা হবে এবং পেঁপের ডাঁট দিয়ে নল তৈরি করা হবে বড় পুকুরের দিকে। একই সাথে দুই দলের দুই পুকুরের নল উন্মুক্ত করা হবে। যাদের পুকুরের পানি আগে শেষ হয়ে যাবে তারা হবে পরাজিত।
মহা উদ্যমে এগিয়ে চলে তাদের কাজ। একসময় দুই দলের পুকুর খনন সমাপ্ত হয়। পেঁপের ডাঁট দিয়ে নল তৈরি করা হয়। নল উন্মুক্ত করে দিয়ে দুই দল অপেক্ষা করছে কাদের পুকুরের পানি আগে শেষ হয় আর কাদের পরে। সবার মুখ থমথমে এবং চিন্তিত। প্রথম দল জয়ী হল এবং উল্লাসে মেতে উঠল। নৃত্য শুরু হল তাদের। জয়ী দলের গিরীশ, খলিল পরাজিত দলের পুতুল, শশীর মুখের সম্মুখে লাগাতার ব্যাঙ্গাত্নক নৃত্য উপস্থাপণ করলে পুতুল, শশী সহ্যের বাঁধ ভেঙে দিয়ে তাদের হাতে লেগে থাকা কাদা ওদের মুখে লেপে দেয়। শুরু হয় গন্ডগোল, হাতাহাতি।
গণ্ডগোল থামাতে ব্যস্ত রাতুল ও অন্যান্য বালক বালিকারা। এরই মাঝে রাতুল দেখতে পায় জহিরুল বাড়ির দিকে যাচ্ছে। গণ্ডগোল ফেলে ছুটে সেদিকে ধাবিত হয় সে। জহিরুলের কাছে গিয়ে সে জিজ্ঞেস করে, দাদাভাই আইসে গেইছো?
হঠাৎ পথে রাতুলকে পেয়ে হাসি ফুটে ওঠে জহিরুলের মুখে, হ্যাঁ চলে আসছি। মারামারি করছিলি?
রাতুল মুখ ঘুরিয়ে গণ্ডগোলটি আরও একবার দেখে নিয়ে জানালো, না আমি করতিছিলাম না, ওরা করতিলো। আমি তো থামাতিলাম।
জহিরুল আবারও হেসে দিয়ে বলল, বাব্বা তুই মারামারি থামাতেও শিখে গেছিস?
জহিরুল আর রাতুল কথা বলতে বলতে ফিরতে থাকে বাড়িতে। রাতুলের বাবারও পেশা ছিল মাছ ধরা। মূলত মোংলার এই অঞ্চল পুরোটাই জেলেদের এবং এখানকার মানুষের একমাত্র পেশা মাছ ধরা। রাতুল মায়ের পেটে থাকাকালীন একটা সময়ে রাতুলের বাবা আরও পাঁচজন সঙ্গী নিয়ে তিন সপ্তাহের জন্যে মাছ ধরা ট্রলার নিয়ে বের হয়। আর ফিরে আসেনি, খুঁজে পাওয়া যায়নি ট্রলারটিও, ফিরে আসেনি সঙ্গী পাঁচজনের কেউ। রাতুলকে জন্ম দিয়ে পৃথিবীর পর্ব চুকিয়ে বিদায় নেয় রাতুলের মা। তারপর থেকে মামা খোকন নিজের কাছে নিয়ে আসে রাতুলকে। সেসব এগার বছর আগের ঘটনা।
জহিরুল কয়েকবার চেষ্টা করেছে রাতুলকে স্কুলে ভর্তি করানোর। খোকন কিংবা আতিয়া কেউ রাজি হয়নি। তাদের ভাষ্য উচ্চ শিক্ষার জন্যে পয়সার যোগান দেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না অতএব পড়াশুনা করে লাভ নেই। বড় হয়ে রাতুলকে জেলে-ই হতে হবে। সুতরাং এখন পড়াশুনার পেছনে ফালতু খরচার কোন মানে নেই। এক সময়ে জহিরুল হাল ছেড়ে দিয়েছে। তবে নিজেই রাতুলকে নিয়ে বসে সন্ধ্যার পর।
রাতুল বেশ উপভোগ করে এই সময়টা। জহিরুল সব কিছুই রাতুলকে গল্প বলার মতন করে পড়াতে থাকে। ধীরে ধীরে রাতুলের একটি কল্পনার জগৎ বেড়ে ওঠে ওর ভেতরে। জহিরুল আসমানি’র কবিতা যেদিন গল্পের ছলে রাতুলকে পড়ায় সেদিন এই চিলা গ্রামকেই বানিয়ে ফেলে রসুলপুর। তাদের ঘরের চালার ফুটো দিয়ে পানি পরতে থাকলে সে বিরবির করে – “একটু খানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পরে পানি”। বৃষ্টিতে ঘর নড়বড় করে, তাদের ছেঁড়া জামা কাপড়, মাঝে মাঝে এক আধ বেলা না খেয়ে থাকা, মারামারি ঝগড়াঝাটি, রোগে ধুপ করে মারা যায় কেউ, মাছ ধরতে গিয়ে সাগর থেকে ফিরে আসে না অনেকে। রাতুলের মনে হয় তারা সবাই রসুলপুরের-ই বাসিন্দা। তার উপর মাঝে মাঝে আবার পিছনের ছোট্ট খাল পেরিয়ে এই গ্রামে বাঘ চলে আসে।
জহিরুলের পাশে পাশে হেঁটে রাতুল এসে বাড়িতে ঢোকে। মাথার ঠিক উপরে সূর্য সবকিছু চৌচির করে চলেছে।
প্রায় মাস খানেক কেটে গেলে একদিন সন্ধ্যের পর একটু দেরি করে রাতুলকে নিয়ে পড়তে বসে জহিরুল নিজের ঘরে। ছোট্ট একটি বেড়ার ঘর; কোনমতে ছাউনী দিয়ে গড়ে তোলা। ঘরের কোন যত্ন না থাকলেও জহিরুল তার সংগ্রহের বইগুলো যত্ন করে রেখেছে এর ভিতরেই। জহিরুল বলে, রাতুল আজকে আমরা পড়বো পিতা-পুত্রের গল্প কেমন!
রাতুল মাথা কাঁত করে জানায়, আচ্ছা। কিন্তু আজ আর তার চোখ মুখ চকমক করে উঠলো না। প্রথমত তার মনে পিতা নিয়ে কোন ভাবলেশ নেই। যাকে সে কোনদিন দেখে নাই, যার কথা সে কোনদিন শোনেনি, মনে তার কোন প্রতিচ্ছবি আসবে না, তাকে নিয়ে কোন আগ্রহ জন্মাবে না এটাই স্বাভাবিক।
জহিরুল গল্প বলতে শুরু করলো।
জহিরুল যতক্ষণ গল্প বলছে রাতুলের মুখ ধীরে কালো বর্ণ ধারণ করতে থাকে। মলিন হয়ে গিয়ে নির্জীব হয়ে যেতে থাকে। সময় কেটে যেতে থাকে এভাবেই।
জহিরুল তখন বলছে প্রায় চার মাস পিতা পুত্রের দেখা নেই। সম্রাট বাবর দুইবার পুত্র হুমায়ূনকে চিঠি লিখলেন। পুত্র চিঠির কোন উত্তর দিল না। একদিন সম্রাট বাবর রাজকার্য পরিচালনা করছেন, এমন সময় দূত এসে খবর দেয় হুমায়ূনের আগমন হয়েছে। সম্রাট বাবর তখনই তার পূত্রকে সামনে আসার আদেশ করেন। দূত তখন জানায় তার পুত্র জ্ঞানহীন অবস্থায় আছে। সম্রাট বাবর রাজকার্য ফেলে ছুটে যান পুত্রের কাছে।
রাতুল ভাবতে থাকে তার বাবা থাকলেও এমন হতো। সেও এমন করেই তার জন্যে অস্থির হয়ে থাকতেন। সব ফেলে তার কাছেই ছুটে আসতেন। আর মাছ ধরতে যেতেন না।
জহিরুল বলে যাচ্ছে, সুফি সাধক মীর আবুল কাশিম সম্রাট বাবরকে বললেন পুত্রের প্রাণের বিনিময়ে আপনি যদি আপনার অতি প্রিয় কিছু দান করেন তাহলে হয়ত-বা শাহজাদার প্রাণ রক্ষা পেতে পারে। সম্রাট বাবরের কাছে তার নিজের প্রাণ ছিল সবচেয়ে বেশি প্রিয়। সে তার নিজের জীবন দান করলেন। সম্রাট বাবর বললেন, আমি আমার পুত্রের ব্যাধি আমার শরীরে ধারণ করলাম, হে পরম করুণাময় আমার পুত্রকে সুস্থ করে দাও। সম্রাট বাবর পুত্রের মাথার কাছে বসে পুত্রের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
রাতুল আর কিছু শুনতে পেল না, জহিরুল তখনও বলে যাচ্ছে। রাতুলের চোখ থেকে টপটপ করে পানি ঝরছে দেখে জহিরুল থামে। রাতুলকে বোঝাতে থাকে যে এটা একটা গল্প। বোকা ছেলে কাঁদেনা বলে সে রাতুলের মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে দিল। রাতুল সেই যে মাথা নিচু করলো সেই রাতে আর মুখ তুলে তাকালো না।
রাতে ঘুমাতে শুয়ে রাতুল বারবার ভাবতে থাকে তার বাবা থাকলে সেও তো এমন করেই ছটফট করতো। তার জন্যে সম্রাট বাবরের মত জীবন দিত। নৌকা বিক্রি করে দিত, আর কোনদিন মাছ ধরতে যেত না। কাঁদলে দাদাভাই যেভাবে মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে দিল সেভাবে হাত বুলিয়ে দিত, কান্না থামাতো। বাবা থাকলে দাদাভাইয়ের মত করেই প্রতিদিন গল্প শোনাতো। এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে যায় সে। সকালে ঘুম ভেঙে উঠে ছুটে যায় দাদাভাইয়ের ঘরে। জহিরুল একটা বই পড়ছে তখন শুয়ে। রাতুল সেভাবে তাকিয়ে থেকেই নিজের মনে জহিরুলকে তার বাবার স্থানে বসিয়ে দিল।
পরদিন বিদ্যালয় থেকে ফেরত এসে মধ্যাহ্নভোজের শেষে সাময়িক বিশ্রামে জহিরুল শুয়ে আছে বিছানায়। বাড়ির বাহির থেকে কেউ এসে হাঁক দেয়। নিজের নাম শুনে জহিরুল কন্ঠ চিনতে পেরে ত্বরিৎ গতিতে ঘর ছেড়ে বের হয়। বাইরে বেরিয়ে জিজ্ঞেস করে, মজনু ভাই কি অবস্থা তোমার?
মজনু ভাই বলল, তুমি তো তোমার চাকরীর দরকারে আমার মুবাইল নম্বর দিয়ে গেইলে।
জহিরুল উৎসুক হয়ে জানতে চায়, ফোন আসছিলো কোন?
মজনু হ্যাঁ সূচক মাথা দুলুনিতে জানায়, হয় ফোন তো আইলো, তোমারে ফিরে আঠাইশ তারিখ যাতি কইছে, চাকরী বলে হইয়ে গেছে। মিষ্টি খাওয়াতি হবি মিয়াঁ।
জহিরুলের মুখে আনন্দরেখা ছড়িয়ে পরে, অবশ্যই খাওয়ামু মজনু ভাই, এমন একটা খবর দিছো অবশ্যই খাওয়ামু।
মজনু বলল, ঠিক আছে এখন তালি যাই, বিকেলে দুকানে আইসো। আর ব্যাতন পালি একটা মুবাইল কিনে নিয়ানে।
জহিরুল হিসাব করে দ্যাখে তার হাতে আরও ছয় দিন সময় আছে। বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে সে সবাইকে সুসংবাদটি দিল। খোকন আতিয়া যখন আনন্দ প্রকাশ করছে, রাতুল তখন বাক্যহীন হয়ে তাকিয়ে আছে জহিরুলের মুখের দিকে। বিকেল হলে জহিরুল খোশ মেজাজে বাড়ি থেকে বের হতে যাচ্ছে এমন সময় রাতুল এসে মাটিতে চোখ রেখে জানতে চাইলো, দাদাভাই, আমারে তোমার সাতে নিবানা?
– নারে, তোকে কিভাবে সঙ্গে নেবো? ওখানে আমার নতুন করে সব শুরু করতে হবে যে।
– তালি তুমি যাইয়ে না, এখানে থাকলি তো আর কিছুই নতুন করে শুরু করতি হবে না।
– ধুরো পাগলা। যা তুই খেলতে যা, আমি একটু বাজার থেকে ঘুরে আসছি।
পরের তিন চার দিন রাতুল কারও সাথে তেমন কথাবার্তা বলল না। মনমরা হয়ে কাটিয়ে দিল পুরোটা সময়। জহিরুলেরও যাবার সময় ঘনিয়ে আসতে থাকে। জহিরুল জানে সে আর কোন দিন এই গ্রামে ফিরে আসবে না। তার প্রস্তুতিও তেমন, একমাত্র সম্বল বইপত্র গুছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেই মত। রাতুলকে সাথে নিয়ে একটি বস্তা বাঁধছে আর বলছে, রাতুল ঠিক মত থাকিস। কাল সকালেই তো আমি চলে যাচ্ছি। এরপর যখন আসবো তোর জন্য কিছু বইপত্র নিয়ে আসব। তবে আমার আসতে দেরি হবে। চাইলেই তো আর হুট করে আসা যাবে না অতদূর থেকে। তার উপর নতুন চাকরী। যাই আগে দেখি কি হয়। তুই ভাল থাকিস বুঝলি?
রাতুল কোনমতে বলতে পারলো, “তুমি চলি গেলি আমারে পড়াবেনে কিডা? গল্প শুনাবেনে কিডা?” এতটুকু বলতেই তার গলা কান্নায় ধরে গেল। রাতুল উঠে ছুটে ভিতরে চলে গেল।
পরদিন সকালে জহিরুল জালিবোটে উঠেছে চিলা রাজার ঘাট থেকে, মোংলা বাজার থেকে বাস ধরতে হবে, দেরি করলে চলবে না। পাড়ে খোকনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে রাতুল লাল বর্ণ মুখ নিয়ে। জালিবোটে ওঠার সময় সে তার দাদাভাইয়ের হাতে এক টুকরো কাগজ দিয়েছে। সে এখনও পড়েনি।
জালিবোট ঘাট ছেড়ে দিলে রাতুল কেঁপে উঠল। জহিরুল হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে গলা ছেড়ে বলল, ভাল থাকিস রাতুল। তারপর উল্টো ঘুরে বসে রইল। আর ফিরে তাকালো না। কিছু সময় পেরিয়ে গেলে সে রাতুলের দেয়া কাগজটি ভাঁজ খুলে পড়ে। তাতে রাতুল লিখেছে একটি লাইন “সব বাবারা-ই কি চইলে যায়”। কি যেন হু হু করে উঠল শরীরের ভিতর। জহিরুলের ইচ্ছা হলো ফিরে গিয়ে নিয়ে আসে রাতুলকে। কিন্তু বাস্তবতা তাকে তা করতে অনুমতি দেয় না। ইচ্ছা হলো ফিরে গিয়ে থেকে যায় চিলা গ্রামেই। বাস্তবতা তাকে তারও অনুমতি দেয় না। জীবনকে এখানে, এই চিলা গ্রামেই থামতে দিতে চায় না সে।
জালিবোট যখন জহিরুলকে নিয়ে দুরত্ব বাড়িয়ে চলছে, রাতুল তখন অপেক্ষা করে তার দাদাভাই যদি একবার ঘুরে তাকায়। পশুর নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে চোখ মুছতে মুছতে সে প্রতিজ্ঞা করে, “আমি বড় হইয়ে তোমারে খুঁইজে বের করবো দাদাভাই”।
© Shihab Shahariare Khan ||