অহোরাত্রির থান
দানবতুল্য বাইশ তলা ইমারতের ছাদের কোনায় দাঁড়িয়ে জানালা আঁকার চেষ্টা করলেন কিছুক্ষণ। তারপর হাল ছেড়ে দিলেন। মধ্যরাত বলে ধুলোর বালাই নেই। তবে মেঘ মেঘ কুয়াশার ঘনত্ব কমিয়ে দিলে এখান থেকে ঘুমন্ত শহরের অনেকটাই দেখা যায়। অদ্ভুত নির্জীব হয়ে আছে যে শহর। যা প্রায়ই এমন নির্ঘাত ভান ধরে থাকে। অথচ অজস্র গুলি চলে এই শহরে। হঠাৎ কেউ একজন পিছন থেকে ঠেলে দিতে যখন নীচে পড়ে যাচ্ছেন, তিনি হয়ত বাতাসকে আঁকড়ে ধরেই নিজের প্রাণটাকে জীবিত রাখতে চাইলেন। কিন্তু নিঃশ্বাস নিতে পারছিলেন না। দম বেগের চাপে আটকে যাচ্ছে এমন অবস্থা। সোজা তাকিয়ে দেখলেন তার চোখের সামনে পাকিস্তান দুইটি ভাগে বিভক্ত হয়ে দুইদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। বাংলাদেশ বহু দূরে সরে গেল। তিনি পরলেন পাকিস্তান অংশে। পাকিস্তানে অলি গলি ধরে হাটছেন আর অপরিচিত এক একজন হুটহাট করে কোত্থেকে এসে তাকে ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করছে – ক্যায়া তুম পাকিস্তানী হো? ক্যায়া তুম পাকিস্তানী হো? ক্যায়া তুম পাকিস্তানী হো? ক্যায়া তুম পাকিস্তানী হো? তখনই ঘুম ভেঙ্গে গেল। ধড়ফড় করে উঠে বসতে গিয়ে নিথর হয়ে পরে থাকলেন কিছুক্ষণ। বিছানার চাদরে অজস্র আঁকাবাঁকা ঢেউ স্পষ্ট হয়ে তাকিয়ে থাকল, তাও নির্জীব। অজস্র আঁকাবাঁকা সেই প্রাণহীনতার উপরে শরীরটির অভ্যন্তরে সবকিছুর খুব অস্থিরতা টের পাওয়া যায়। হার্টের বিপিএম কত হবে এখন! একশত’র কাছাকাছি প্রায়। বয়স হচ্ছে। লহমায় বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।
মটরসাইকেল যখন তাকে নিয়ে সাঁই সাঁই করে ছুটে যাচ্ছে তখন মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। ইঞ্জিনের গর্জন তুলে ছুটে আসছে দূরপাল্লার কিছু ভারী গাড়ি। গাড়িগুলো চলে গেলেই অদ্ভুত শান্ত হয়ে থাকে রাস্তাঘাট। তিনি ভাবতে থাকেন এটিও ভান। এই শহরের রাস্তাগুলো মোটেই শান্ত নয়। হবেও না কোনদিন। সময়ে সময়ে শুধু সাজসজ্জা পাল্টাবে প্রচন্ড স্বার্থপরের মতন। ল্যাম্পপোষ্টের সোডিয়াম আলোগুলোও সাজ পাল্টে সাদা আলো হয়ে যাচ্ছে। একসময় সোডিয়াম আলো শরীরের কিংবা পোষাকের রং পাল্টানোর খেলা খেলত। মানুষই আমূল পাল্টে যাচ্ছে এখন, সাদা আলোয় তাই সমস্যা হয় না কোন। পোষাক পাল্টানো নিত্য নতুন মুখোশ পরিহিত উটপাখি সব।
কোন মধ্যান্তর না নিয়ে ফার্মগেটে পৌছে পুলিশ বক্সের সামনে থামলেন, মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন বন্ধ করলেন। বক্সের সামনে টুলে বসে থাকা দুইজন হাবিলদার উঠে স্যালুট মারলেন। গা করলেন না তিনি। এই তার অপ্রিয় ফার্মগেট। কর্তব্য জীবনের শুরুর দুই বছর কাটাতে হয়েছে ফার্মগেটে। রোদ বৃষ্টিতে সারাদিন শেষ করে সহ্য করতে হয়েছে বহু অপমান। অতঃপর চলন্ত জড় পদার্থ রুপে ফিরে গিয়েছেন মেসে। সে এক জীবন ছিল বটে। আজ সে নিজেও ফার্মগেটে কাউকে সম্মান দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না। যা ভেতর থেকে আসে না তাকে আর জোর করে টানাছেঁচড়া করার কোন দায় নেই তার।
কব্জির ইশারায় হাবিলদার দুইজনকে দূরে সরে যেতে বললেন। তার হুকুম পালনে দেরী হয় না হাবিলদারদের। দূরত্ব বাড়লে তিনি সিগারেট জ্বালিয়ে তাকিয়ে থাকেন রাস্তার অপর পাশে। আবছা আলোতে কিছু একটা নড়ছে বুঝতে পারেন। নির্বিকার লক্ষ্য করতে থাকেন। আকৃতি বুঝতে অসুবিধা হয় না তার। মানুষ। চুরির মতলবে আছে হয়ত। হঠাৎ শব্দ হতে ছায়ামূর্তিটি গলি থেকে হুমড়ি খেয়ে দৌড়ে বেড়িয়ে আসে। উল্টো দিকে তাকে দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়ায় কিছুটা তারপর ধীর গতিতে এগিয়ে যেতে থাকে। নির্বিকার তিনি একইভাবে সিগারেটের ধোঁয়া মহাশূন্যে উড়িয়ে দাঁড়িয়ে অবলোকন করতে থাকেন। ছায়ামূর্তি ক্রমে আড়ালে চলে যায়। ঠিক এক সেকেন্ডের জন্যে হাসেন তিনি, বেশি নয়। অপরাধী ঠাহর করতে আর এক দন্ড লাগে না তার। তবুও কিছু কিছু ছেড়ে দেন।
ছেলেবেলায় কিছু একটা স্বপ্নে দেখে ঘুম ভাঙল তার। সন্ধ্যারাত। চারিদিক সম্পূর্নই নিস্তব্ধ। বাবা মা দুজন’ই ঘুমাচ্ছে বুঝতে পেরে কিসের টানে যেন বিছানা ছেড়ে নেমে অন্ধকার হাতড়ে বাড়ির সামনের ঘরে এগিয়ে গেলেন। ঝিমঝিমে পরিবেশ, সর্বময় মিটমিটে টিমটিমে নিভুনিভু আলো। কিছুটা অগ্রসর হতে তার খেয়ালে এলো এখন এই সন্ধ্যারাতে কেন সবাই ঘুমিয়ে থাকবে! এখন তো কারও ঘুমিয়ে থাকার কথা নয়। আন্দাজ করতে পারলেন বাহিরের পরিবেশও বেশ ঘুমন্ত। বাহির থেকে টু শব্দটিও আসছে না। তবে রাস্তার ল্যাম্পপোষ্টের আলো প্রবেশ করছে ঘরে। অথচ এখন সবার জেগে থাকার সময়, চা নাস্তার আয়োজন করবে, খাবে। অমনি খেয়াল করলেন বাহিরের দিক থেকে একটি হাত জানালা দিয়ে ঘরের পর্দার ফাঁক দিয়ে খুব সন্তর্পনে ভিতরে প্রবেশ করেছে। অন্ধকার বলে কিনা জানেন না, হাতটি কুচকুচে কালো। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে হাতটিকে দরজার ভেতরের ছিটকিনি হাতড়াতে দেখলেন। ক্রমশ ঘোলাটে কালো ব্যাক্তিটির শারীরিক অবয়বও স্পষ্ট হয়ে উঠল। ধড়ফড় করে উঠল তার বুকে। একি! লোকটি দরজা ছিটকিনি খুলতে পারলেই ভেতরে ঢুকে পরবে। কে সে! চোর না যাদুকর! ক্ষতি করবে নিশ্চয়। চিৎকার করে বাবা মাকে ডাকতে গিয়ে বুঝতে পারলেন তার গলা রোধ হয়ে আছে। কোন আওয়াজ নেই তাতে। তিনি প্রচুর চেষ্টা করেও কণ্ঠে একটুও আওয়াজ তুলতে পারলেন না। দু’হাতে গলা চেপে ধরলেন নিজের তুবও কোন পরিবর্তন ঘটলো না। নিমেষে ঘেমে যেতে থাকলেন। এমন সময় দেখলেন জানালার লোকটি তার বরাবর এক দলা থু থু ছিটিয়ে দিচ্ছে। ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে যখন বসলেন তখন তিনি নিঃশ্বাস টানতে পারছেন না। সারা শরীর ঘামে চুপচুপে ভেজা। গলা শুকিয়ে যা তা অবস্থা। জিহ্বায় এক বিন্দু লালা নেই। স্বপ্নের কথা মনে পরতে জানালার দিকে তাকালেন। সব ঠিক আছে, পর্দাও স্বাভাবিক ভাবে দুলছে। পনের-বিশ বছর আগের তিনিও এখন আর তিনি নেই, তাদের সেই বাসাও নেই। তবে বারবার মনে হতে থাকল তিনি এই একই স্বপ্ন আগেও কয়েকবার দেখেছেন। আসলেই দেখেছিলেন কিনা; কবে দেখেছিলেন খেয়াল করতে পারলেন না। বিছানায় আর স্থির হতে পারলেন না। ঘড়িতে দেখলেন রাত দুই অতিক্রম করে সাতচল্লিশ মিনিট। সাতচল্লিশের দেশভাগটাই যত ভাঙ্গনের মূল আওড়ালেন। সেকেন্ডের কাটা সচল। বিপিএম একশ’র বেশি হবে।
বিজয়স্মরনীর মোড়ে টিমটিমে আলোয় নারীদেহটিকে খুব খেয়াল করে অবলোকন করলেন এতক্ষণ। এরা আসলে স্বাভাবিকতার সংজ্ঞার বাহিরের ধাতের। অনেক বছর ধরে দেখে এটিই বুঝলেন তিনি। এরা স্বাভাবিকভাবে তাকাবে না, খাবে না, কথা বলবে না, হাটা তো দূরের কথা। নারী – এই এক প্রজাতির মনুষ্যের সাথে তার কখনও সখ্যতা হল না। কাছাকাছি, পাশাপাশি, মাখামাখি কোনটিই না। মাঝে মাঝে ওদের বুকের গাঢ় ভাঁজে তাকিয়ে দেখেছেন, অন্যরকম অনুভূতি হয় ঠিকই তবে কর্তব্যজীবনের শুরুতে নয় লক্ষ টাকার ধকল মাথায় নিতে হয়েছে। শুরুতে নিজের চাকরী পাওয়ার জন্যে জোগাড় আর পরে তা শোধ দেয়ার জন্যে কারও কিংবা একাধিকের কাছ থেকে জোগাড় করতে করতে যৌবনের ধকল এলেও ভুলে থাকতে হয়েছে। আদর্শবান বাবার আদর্শ বর্তমানের বাজারে ছেলের কাছে টেকেনি। বিয়ে সন্তান সংসার সেসব তার বাবা পর্যন্তই।
এই শহরে প্রায়শই তার হুকুমে মাইকে কিংবা গোপনে ঘোষনা চলে, লন্ড ভন্ড হয় কতকিছু, তান্ডব চলে আড়ালে কিংবা প্রকাশ্যে। তিনি প্রায়শই হুকুম জারি করে নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে অফিসের পেছনে তার বাসভবনে ফিরে যান। সংসারহীন একা মানুষ, যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। অবহেলা করতে পারেন না কেবল তার অধস্তন কয়েকজন অফিসারের বেলায়। ধাপটি মেরে থাকে এক একটা – শালা। সুযোগ পেলেই টপকে যাওয়ার ধান্ধা সব সময়। বিশ্বাস করা যায় না কাউকে। এদিক থেকে সুযোগ গেলে ওদিক থেকে ছোবল আসবে – এই নিয়ম। তাই কোন ছাড় তিনিও ছাড়েন না। তটস্থ করে রাখেন সবাইকে।
পরদিন প্রায় অনেক রাতে অফিস কক্ষে বসে যখন তিনি বাসভবনে ফিরে যাওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছেন বাহির থেকে হৈ-হল্লার ধ্বনিতে ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলেন। চুপ করে কিছুক্ষণ শুনলেন, বুঝলেন প্রহার চলছে। মনে করার চেষ্টা করলেন প্রহারের আর একটি ভাল বাংলা আছে। অতঃপর দশ-এগার সেকেন্ডের মাথায় মনে করতে পেরে খুশিও হলেন। অফিস কক্ষের বাহিরে চলমান নিগ্রহের কেমন একটা ছন্দ আছে। সেটি ধরতে পেরে তার মন আরও প্রসন্ন হল। নির্মল সন্তুষ্ট মনোভাব নিয়ে আসন ছেড়ে দরজায় উপস্থিত হলেন। দেখলেন ছেলেটির বাম কপাল থেকে ইতিমধ্যে রক্ত ঝরছে। অষ্টম শ্রেনীতে পড়াকালীন সময়ে আবুল চাচার আমের গাছ থেকে চুরি করে আম খেতে গিয়ে তারও বাম কপাল কেঁটেছিল। ছেলেটি নেহায়েতই যুবক, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া হবে হয়ত বা তারও কম। তিনি সবাইকে মার বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন এবং ছেলেটির মুখ পরিষ্কার করে তার কক্ষে পাঠাতে বললেন।
ছেলেটির মুখেই শুনলেন বিস্তারিত। রাত সাড়ে নয়টার মতন বেজেছে এমন সময় সে পলাশীর মোড় হয়ে ফিরছিল ধানমন্ডির উনিশ নম্বরে তাদের মেসের উদ্দেশ্যে। পলাশীর মোড় থেকে যে রাস্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে গিয়েছে সেই রাস্তার ঘটনা। দুইটি মেয়ে এগিয়ে আসছিল কথা বলতে বলতে। উল্টো দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছিল একদল যুবক উচ্চস্বরে গান গাইতে গাইতে।
এমন সময় ছেলেটিকে কক্ষে নিয়ে আসা অফিসারটি প্রশ্ন করলেন, কি গান? কার গান?
ছেলেটি জবাবে জানালো, জেমসে’র – দুষ্টু ছেলের দল, মিষ্টি মেয়ের দল।
অফিসার বললেন, দে দে তালি, দে তালি। তারপর বলেন কি হইছে।
ছেলেটি আবার বলতে আরম্ভ করলেন। যুবকদের দলে মোটামোটি দশ বারোজন ছিল। মেয়ে দুইটি তাদেরকে এড়িয়ে ফুটপাতের পাশ ঘেঁসে বের হয়ে আসছিল। কিন্তু যুবক দলে তিনজন পথ আটকে দাঁড়ালো। পথ আটকে দাঁড়াতেই বাঁকি যুবকেরা কনসার্টে আমরা যেভাবে নাচি ঠিক সেভাবে নাচতে নাচতে গাইতে গাইতে মেয়ে দুইটিকে চারদিক থেকে ঘীরে ধরে। অতগুলো ছেলের আড়ালে মেয়ে দুইটি ঢাকা পড়ে গেল। গানের জোয়ারে মেয়েদের চিৎকারও আর শুনতে পাওয়া গেল না। আমি একা হেঁটে আসছিলাম। চোখের সামনেই সব ঘটতেছে। বিশ্বাসও হচ্ছিল না। হতবম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। জটলাটাকে দেখলাম একটা দেয়ালের আড়ালে চলে গেল। মেয়ে দুইটিকে আর দেখতে পেলাম না। দূরে একটা রিক্সাওয়ালাকেও দেখলাম আমার মতন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে। মিনিট পাঁচেক পরেই দেখলাম দলটি তেমন গান গাইতে গাইতে চলে গেল। তবুও মেয়ে দুইটির আর দেখা মিলল না। যখন দলটি চোখের আড়ালে চলে গেল। দেখলাম রিক্সাওয়ালা তার রিক্সাটি টেনে সেই দেয়ালের কাছে গিয়ে থামল। রিক্সা রেখে দেয়ালের আড়ালে ঢুকে গেল। আমিও সেদিকে হাঁটা শুরু করলাম। ইতিমধ্যে দেখি রিক্সাওয়ালা একটি মেয়েকে মোটামোটি কোলে করে নিয়ে তার রিক্সায় উঠাচ্ছে। আমি যখন কাছাকাছি পৌছে গেছি তখন রিক্সাওয়ালা অন্য মেয়েটিকেও পাঁজাকোলে করে এনে তার রিক্সায় উঠাইছে। দেখলাম মেয়েদুইটির জামা কোন জায়গায় ছিড়তে বাকি রাখে নাই ওরা। রিক্সাওয়ালাকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই উনি বললেন – “যাই এনাগো বাসায় দিয়া আহি। পোলাগুলার কয়ডা আমার রিক্সাতেই আইছিল। ভাড়া চাইছিলাম দেইখা আমারে থাপড়াইছে”। রিক্সাওয়ালা মেয়ে দুইটিকে নিয়ে চলে যাওয়ার পর আমার শরীর যেন ক্যামন গুলিয়ে উঠলো। পেটের ভেতর প্রচন্ড পাক খেল। পরপর তিনবার আমি ওইখানেই ফুটপাতে বসে বমি করছি। সেখান থেকেই ওনারা আমাকে থানায় তুলে নিয়ে এসেছেন। ওনারা বলছেন শহরের এমন অবস্থায় আমি নাকি গাঁজা খেয়ে বমি করছিলাম।
তিনি এতক্ষণ সব শুনলেন। বুঝলেনও সব। তিনি এখন সব বোঝেন। অধস্তন অফিসারকে ইশারা করলেন পাশের রুমে নিয়ে যেতে। বলে দিলেন – ফাস্ট এইড দিয়ে ছেড়ে দিন। ঝামেলা বাড়ানোর দরকার নেই।
নির্দেশপ্রাপ্ত আফিসার ছেলেটিকে রুম থেকে নিয়ে বের হয়ে যেতেই টেলিফোন বেজে উঠলো। টেলিফোনে শুধু তাকে ‘হু হু’ বলতে শোনা গেল। শেষে “জি স্যার আপণি ভাববেন না, আমি দেখছি” বলে ফোন রাখলেন।
বেল চেপে সেই অফিসারকে আবার তলব করলেন। অফিসার এলে ছেলেটির ফাস্ট এইডের কতদূর কি হল সেই খবর নিলেন। তারপর বলে দিলেন, “ফাস্ট এইড দেয়া শেষ হলে ওকে কতক্ষণ প্যাঁদাবেন, তারপর স্বীকার করাবেন যে ঐ ছেলেগুলোর মধ্যে ও নিজেও ছিল, এটাই হুকুম”।
সেইরাতে যখন ছয় সাতজন চারপাশ থেকে তাকে ধীরে ধরলো তিনি আর কিছু বলার কিংবা প্রতিরোধ করার শক্তি খুঁজে পেলেন না। কেমন অবশ হয়ে গেল তার শরীরের প্রতিটি শিরা উপশিরা, প্রত্যেকটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। তারপর জ্ঞান হারালেন। জ্ঞান যখন ফিরে পেলেন তখন তিনি কোন গভীর অরণ্যে শ্যাওলার ওপর পড়ে আছেন। তার পিঠের দিকটা সম্পূর্ণই ভেজা। সেঁটে আছে আঠালো কিছুতে। শরীর ঘিন ঘিন করে উঠল। পরক্ষণেই কয়েকজনের আগমনের শব্দ পেয়ে তিনি উঠে ছুটতে শুরু করলেন, প্রথমে মোটামোটি গতিতে তারপর দিকবিদিক হয়ে। ছুটতে ছুটতে তিনি সম্মুখে একটি পুকুর পেয়ে সেটিতে নেমে গেলেন। কোনমতে নাক ভাসিয়ে নিঃশ্বাস নেয়ার চেষ্টা করতে থাকলেন। চারিদিক তখন ম্যাটম্যাটে বিষন্ন নিশ্চুপ, দেখলেন থেমে আছে সব শুধু বিপরীত ধর্মী আলোর আভা বয়ে যাচ্ছে। পুকুর পাড়ের অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে দেখলেন একটি গাছ থেকে খুব ধীরে অনবরত সবুজ পাতা ঝড়ে যাচ্ছে। সেদিকে তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। এমন মুহুর্তে তার দুই পায়ে স্পর্শ টের পেলেন। এতটুকুই। তারপর অকস্মাৎ কেউ তাকে স্ববেগে টেনে পানির নীচে নামিয়ে নিয়ে গেল। শুরুতে কিছুই দেখতে পেলেন না কিছুক্ষণ। যখন পানির ঘোলাটে ভাব কিছুটা কমে এসেছে ততক্ষণে তিনি তার হাত, পা, পীঠ এমনকি সর্বাঙ্গে অপরের হাতের স্পর্শ পেতে থাকলেন। চারদিক থেকে তাকে ঘিরে ধরেছে এগারো-বারো জন। এতগুলো অপরিচিত পুরুষলোক সেই পানির নীচে তার শরীরে হাত দিয়ে যাচ্ছে। হাত ঘষছে যার যেখানে খুশী। কেউ কেউ নিতম্বে চাপ বসাচ্ছে। বুকে হাত দিচ্ছে দুই চার জন। পিছন থেকে কে যেন হাত গলিয়ে দিল তার যৌনাঙ্গে। জামা কাপড় টেনে ছিড়তে শুরু করলো কয়েকজন। একসময় ওদের হাতের বেগ কিছুটা কমে এলে কোনমতে এতটুকু ছাড় পেয়ে কেটে বেরিয়ে যেতে চাইলেন। সাঁতরে প্রায় যখন কিনারে চলে এসেছেন পেছনে পানির উপরে অনেকগুলো পুরুষ হাত তার শরীরকে কেন্দ্র করে এগিয়ে আসতে দেখে তিনি আবার ছুটলেন। ভেজা কাপড়ে বেগ ওঠাতে পারেন না। ঘন গাছপালার মধ্যে দিয়ে বেশি একটা ছোটাও যায় না। এমন সময় তিনি কাঁধে আবার একজনের হাতের স্পর্শ পেলেন। আর সেদিকে তাকালেন না। হন্যে হয়ে শুধু ছুটে যেতে চাইলেন। পালাতে চাইলেন প্রবল বেগে। শরীরে আর যেন কোন জোর নেই, অবসাদ গিলে ফেলছে সব। তিনি কোন রিক্সাওয়ালাকে খুঁজলেন। পলাশীর সেই রিক্সাওয়ালাকেও পেলেন না কোথাও। কেউ নেই কোথাও, শুধু কাঁধে একটি হাত তাকে টেনে উল্টো দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে করে যাচ্ছে। টেনে সেদিকে ফেরানোর চেষ্টা করছে। না পেরে তারপর ঝাকাচ্ছে। আজব, ঝাকাচ্ছে কেন? হালকাভাবে আড়চোখে ঘুরে তাকাতেই দেখলেন এ তো তার বাবা। বাবাকে দেখে তিনি স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকলেন।
বাবা কিছুটা হাসলেন। তারপর বললেন, আর কত ঘুমাবি বাবা? নামাজ পড়বি না? ওঠ নামাজটা পড়ে তারপর আবার না হয় ঘুমাস। ওঠ এখন।
তিনি ধড়ফড় করে জেগে উঠে বসলেন। ঘেমে ভিজে আছেন সম্পূর্ণ। বুকের ভেতরে যেন অজস্র বুনো মোষ দৌড়ে যাচ্ছে। ভূমি ডেবে যাচ্ছে, ধুলো উড়ছে প্রচুর। বাবা মারা গেছেন তের বছর হয়ে গেল। অনেক সময় চোখের পলকে নিভে গেছে।
মটরযানে চেপে তিনি যখন ছুটে চলেছেন তখন রাতের শেষটাও শুরু হয়নি আবার দিনের শুরুটাও শেষ হয়নি। কোথায় যাবেন তিনি জানেন না। শুধু জানেন তাকে যেতে হবে। থেমে গেলেই মরণ। এমন কিছু মানুষ কখনও থামতে পারেন না। ছুটে চলেন অবিরত। নিজেকে ছেড়ে – নিজেকে রেখে বেড়িয়ে যেতে চান। প্রতিদিনই তার মনে হতে থাকে আজকে হয়ত বেড়িয়ে যেতে সমর্থ্য হবেন, কিন্তু একদিন তিনি নিজেই ভুলে যান যে তিনি নিজেকে রেখে – নিজেকে ফেলে কোন এক অজানার দিকে ধেয়ে যেতে চাইতেন। ভুলে যান সেই অজানা দিগন্ত তার মাঝেই ভিটে-বসত-বাড়ী গেড়ে বাস করে চলেছে অনেকদিন যাবত।
© Shihab Shahariare Khan ||